ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও স্বাধীনতা স্বপ্ন

ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও স্বাধীনতা স্বপ্ন


আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগের কথা। বাইতুল মুকাদ্দেস তথা জেরুজালেম শহর তখন খ্রীষ্ঠানদের দখলে। এমনই এক সময় বাগদাদ শহরে বাস করতো এক কাঠের কারিগর। একদিন সে কাঠ দিয়ে অসাধারণ সুন্দর এক মিম্বর বানালো। মিম্বরের কারুকাজ দেখে সকলে মুগ্ধ হয়ে গেলো। সবাই এসে তার কাছ থেকে মিম্বরটি কেনার চেষ্টা করলে সবাইকে সে বললো এটি শুধুমাত্র বাইতুল মুকাদ্দাসের জন্য বানানো হয়েছে। সবাই তখন বললো...বাইতুল মুকাদ্দেস তো খ্রীষ্ঠানদের দখলে। কালের বিবর্তনে এই কাহিনী লোককথায় পরিনত হলো এবং সবাই সেই মিম্বরের কারুকাজ এবং সৌন্দর্যের বর্ননা শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত। এভাবে একদিন এক সাধারণ যুবকও সেই গল্পটি শুনলো। কিন্তু সে যুবক অন্যদের মত মিম্বরের কারুকাজের বর্ননায় মুগ্ধ না হয়ে মিম্বর বানানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভাবলো। ১১৮৭ সালে সেই যুবকের নেত্রীত্বে শেষবারের মত বাইতুল মুকাদ্দেস বিজয় হয়। ইতিহাস সেই যুবককে গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী নামে জানে। সেদিন থেকে পরবর্তী ৭৬১ বছর বাইতুল মুকাদ্দেস মুসলমানদের অধীনে ছিলো যা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানদের হাতছাড়া হয়। ২য় ও ৩য় ক্রুসেডের যুদ্ধেও জেরুজালেম-কে তিনি রক্ষা করেন! তিনি মারা যাওয়ার পর মামলুকরা ক্ষমতা দখল করে। ১৫১৭ সালের দিকে মামলুকদের পতন ঘটে। 

তখন, তুরস্কে এক লোক ওসমান রা: এর সাথে মিল রেখে তার ছেলের নাম রাখে ওসমান। ইংরেজিতে ওসমানকে বলা হয় অটোমান যারা মামলুকদের পর ১৯০০ সালের শুরু পর্যন্ত ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবী শাসন করে।

তখন, ইহুদিদের প্রতি অনেক খারাপ আচরন করা হতো।১৯০০ সালের দিকে 'Theodor Herzl' নামে একজন ইহুদি লেখালেখি শুরু করেন যে এই নির্যাতন থেকে ইহুদিদের বাচতে হলে একটা স্বাধীন দেশ দরকার। ইহুদি ধর্মের জন্য যে দেশ দরকার যে একটা ধারনা এইটাই হলো যায়োনিজম। আর যারা এই ধারনা বিশ্বাস করে তারাই হলো যায়োনিস্ট। অনান্য ইহুদিরাও এই ধারনায় এক হতে শুরু করলো। তখন তাদের চোখ পড়লো ফিলিস্তিনের দিকে কারন বাইবেলে লেখা ছিল একসময় ইহুদিরা জেরুজালেম শাসন করতো। যেহেতু অটোমান এমপায়ার মুসলিম শাসিত এবং কোনো ধর্মের মানুষকেই নির্যাতন করতো না, তাই তারা ফিলিস্তিনেই আশা শুরু করলো। এরপর, ব্রিটিশ-আমেরিকা অটোমান এম্পায়ারের পতন ঘটায়। আরব দেশগুলোও ক্ষমতা ও স্বাধীনতার লোভে পশ্চিমাদের সাথে হাত মেলায়। অটোমানদের পতনের পর ব্রিটিশরা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আনা শুরু করে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ লর্ড ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষনা দেয়; যা বেলফোর ঘোষনা নামে পরিচিত। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করে যার ফলে আরো ইহুদি ফিলিস্তিনে আসা শুরু করে। 


১০০০ বছরের ও কম সময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যাই বাড়ছিলো। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে যায়। জাতিসংঘ প্রায় ৬০% জায়গা দিয়ে দেয় ইসরায়েলকে আর জেরুজালেম ছিলো কমন। এর পরেই ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে David Bengurion ইসরায়েলর স্বাধীনতা ঘোষনা দেয়। আর আরবরা এটা মেনে নেয়নি তাই ঠিক একদিন পরেই ১৫ মে শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। একদিকে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ইরাক আর অন্যদিকে ছিলো ইসরায়েল সহ পশ্চিমা বিশ্ব। সেই যুদ্ধে আরবরা নিজেদের দোষেই হারে। সেই যুদ্ধে মিশর ও জর্ডান কিছু যায়গা রক্ষা করে।মিশরের দখলকৃত যায়গার নামই হলো গাজা আর জর্ডানের দখলকৃত যায়গার নামই হলো সেই পশ্চিম তীর। ইসারায়েল সকল ফিলিস্তিনিকে এই ২ জায়গায় স্থানান্তর শুরু করে। পরবর্তীতে, ১৯৫৭ সালে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার জন্য একটা সংগঠন প্রতিষ্টিত হয়, যা ফাতাহ নামে পরিচিত। যাইহোক, ১৯৬৭ সালে শুরু হয় ২য় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ যেখানে ইসরায়েল পশ্চিমাদের থেকে শতভাগ সাহায্য পায় এবং ইসরায়েল মিসরের সিনাই উপদ্বীপ দখল করে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোওয়ার সাদাতের বেইমানির কারনে এই যুদ্ধে আরবরা হারে। পরবর্তিতে, ইসরায়েলকে স্বীকৃতির বিনিময়ে তা ইসরায়েল ছেড়ে দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের যা যায়গা ছিলো তাও দখল হয়ে যায়। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যক রবিন কে নিয়ে আমেরিকা একটা চুক্তি করে যা অসলো একর্ড ১ ও ২ নামে পরিচিত। আরব বিশ্ব-সহ বিভিন্ন দেশের চাপ ও মিডিয়া-তে নিজেদের ইমেজ ঠিক করতে আমেরিকা এই চুক্তি করতে বাধ্য হয়। যাই হোক, ২ টি চুক্তিরই মুল বিষয় ছিলো, গাযা ও পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনেরিই থাকবে আর জেরুযালেম ২ দেশের জন্যই কমন থাকবে। কিন্তু, ইসরায়েল এটা মানে নাই। জেরুজালেমে মুসলমানদের ডুকতে দেয়া হয় নাই সাথে আর, হত্যা, নির্যাতন তো আছেই। পরবর্তীতে এই চুক্তির কারনেই, হত্যা করা হয় আইজ্যাক রবিনকে। আর, এই হত্যার পেছনে ছিলো ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। 


যাই হোক, ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনে একটা গনজাগরন ঘটে। ফিলিস্তিনিদের যা ছিলো তা দিয়েই তারা প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করে যা প্রথম ইনতিফাদা নামে পরিচিত। তখন এক দল মানুষ ছিলো যারা কোনোভাবেই ইসরায়েলকে মানতে পারতো না। এদেরকে নিয়েই ১৯৮৯ সালে আহমেদ ইয়াসিন প্রতিষ্ঠা করে হামাস। পরবর্তিতে ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে হয় সাধারন নির্বাচন যেখানে হামস নিরংকুশ বিজয় লাভ করলে। কিন্তু, পশ্চিমা চাপে মাহমুদ আব্বাস ক্ষমতা হস্তান্তর করে নাই এবং ফাতাহ ইসরায়েলের সাহায্যে হামাসকে পশ্চিম তীর থেকে শেষ করে দেয়। সেই থেকেই হামাস গাযা-র নিয়নত্রন নিয়ে নেয়। তারপরপরই, ইসরায়েল গাযার ৩ দিকই ব্লক করে দেয়। সমুদ্রেরও বড় একটা অংশের নিয়ন্ত্রন করে ইসরায়েল। গাযাকে বলা হয় 'World's Largest open air prison'। গাযার খাবার, পানি, বিদ্যুত, ইন্টারনেট পুরুপুরি নিয়ন্ত্রন করে ইসরায়েল। ইসরায়েল সব সময়-ই হামাস-কে ধংসের নামে গাযায় বোমা হামলা করে এবং নারী, শিশু-সহ সাধারন মানুষকে হত্যা করে। ইসরায়েল, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইউরোপ-সহ অনেক দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করলেও, মুসলিম বিশ্বের কাছে হামস এক মুযাহিদিন ও স্বাধীনতাকামী সংগঠন।


২০০৭ সাল থেকেই গাযার নিয়ন্ত্রন করে হামাস আর পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রন করে মাহমুদ আব্বাসের দল ফাতাহ। বর্তমানে পশ্চিম তীরের ৬০% নিয়ন্ত্রন করে ইসরায়েল আর বাকি ৪০% নিয়ন্ত্রন করে মাহমুদ আব্বাস। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাযায় তেমন কোনো ইসরায়েলি দখলদারিত্ব নেই বললেই চলে অন্যদিকে মাহমুদ আব্বাসের পশ্চিম তীরে যখন-তখন ইস্রায়েল ডুকে পড়ে। বর্তমানে ইস্রায়েলি কারাগারে থাকা প্রায় ১০,০০০ ফিলিস্তিনির মধ্যে প্রায় সবই পশ্চিম তীরের। ইস্রায়েলি এসব কাজকর্মের সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী হলো আমেরিকা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্টার কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বীকৃতি দেয় আমেরিকা। আমেরিকার শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি এর প্রায় ৪০%-ই ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রনে। আমেরিকার রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ধারিত হয় ইহুদিদের দ্বারা। প্রতি বছর ইসরায়েলকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য দেয় আমেরিকা। ২০১৭ সালে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইস্রায়েলের বলেই স্বীকৃতি দেয় এবং এম্বাসি প্রতিষ্টা করে। ২০২০ সালে আমেরিকা মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার আলোচনা শুরু করে এবং বাহরাইন, সুদান, দুবাই এবং মরক্কো স্বীকৃতি দেয়। সম্প্রতি সউদি আরবও আলোচনা শুরু করে স্বক্রিতির ব্যপারে।


যখন ঘোষনা হয় শনিবার মোহাম্মদ দেইফের বক্তব্য প্রাচারিত হবে তখন-ই ফিলিস্তিনিরা বোঝে যায় এদের ভাগ্যে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ৭-ই অক্টোবর ভোরে ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৫০০০ রকেট ছোড়া হয় ইস্রায়েলে দিকে। একই সময়, গাযার ব্যরিকেড ভেংে এবং প্যারাসুট নিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধারা। অন্যদিকে, হামাসের নৌ ইউনিট স্পীড বোট নিয়ে ডুকে যায় ইসরায়েলি জলসীমায়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে অবিশ্বাস্য কম সময়ে পতন ঘটে ইস্রায়েলের গাযা ডিভিশনের। প্রায় ২৫০ জন ইসরায়েলিকে ধরে নিয়ে আসে হামাস যোদ্ধারা। গাযা ডিভিশনের বেশ কিছু সার্ভার ও নিয়ে আসে হামাস যোদ্ধারা; ধারনা করা হয় ইস্রায়েলর অনেক গোপন তথ্য এখন হামাসের হাতে আছে। পরাশক্তি হওয়ার পথে থাকা পরমানু শক্তিধর ইসরায়েলের জন্য এই হামলা ছিলো তাদের প্রতির্রক্ষা ব্যবস্থায় প্রচন্ড দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ, যা ইরান-ও প্রমান করে দেখিয়েছে। হলোকাস্টের পরে ইসরায়েলের ইতিহাসে এটিই ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। ৭ই অক্টবর-এর এই হামলা ছিলো যায়োনিস্টদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার একটা প্রচেষ্টার শুরু মাত্র।


৭-ই অক্টোবর এর এই হামলার পেছনে অনেক গুলো কারন ছিলো:

১ম কারন হলো, আল-আকসার পাশে ইহুদিদের 3rd Temple প্রতিষ্টা করা, যা এই হামলার পর আপাতত স্থগিত। 

২য় ত, সৌদির সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে এবং গোপনে ইসরায়েলের সরকারি লোকদের সাথে দেখা করেন। যার উদ্দ্যেশ্য ছিলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি। এই হামলার পর আপাতত স্বীক্রিতির বিষয়টা স্তগিত করেছে রিয়াদ। 

আরেকটি কারন হলো, আগে শুধু ইসরায়েলি আর্মি নির্যাতন করলেও, এখন অবেইধ ইস্রায়েলি সেটলার-রাও ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন শুরু করেছে। এখন একটা ব্যবস্তা না নিলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরো ভয়াভয় হবে।

হামলার ব্যাপারে হামাসের পূর্ন বক্তব্য


 

৭-ই অক্টোবর এর এই হামলা পশ্চিমাদের মানবাধিকারের ভন্ডামির মুখোশ উন্মোচন করেছে। গনতন্ত্র, মানবাধিকার, আত্য্রক্ষার কথা বলতে বলতে হয়রান পশ্চিমাদের জন্য এই হামলা ছিলো তাদের ইমেজের জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা। অন্যদিকে, পশ্চিমা মিডিয়াও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। যুদ্ধ শুরুর পর, ফেসবুক প্রায় ১০ লাখ ফেসবুক আইডি ডিসেবল অথবা ডিলেট করেছে শুধুমাত্র হামাসের পক্ষে পোস্ট করার জন্য। যুদ্ধ শুরুর পর, মেটা ও টিকটক ইসরায়েলের ৯০% কন্টেন্ট ডিলেটের অনুরোধের সাড়া দিয়েছে। ৭৬ বছর ধরে নির্যাতিত একটি জাতির স্বাধীনতার চেষ্টা হলো এই হামলা। ফিলিস্তিনিরা অপেক্ষা করছে নতুন কোনো আইয়ুবির যে ফিলিস্তিনিদের এই বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা করবে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post